মেহেরপুর একাত্তর, ২৭ জানুয়ারি:
দেশে প্রথম ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতাল চালু করেছে মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। এ হাসপাতালে কৃষির উৎপাদন এবং রোগবালাই রোধে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা। আর ভ্রাম্যমাণ এ হাসপাতালে পরামর্শ নিতে কৃষকরাও আসছেন আগ্রহ নিয়ে। কৃষকরা পাচ্ছে সুফলও। কৃষকদের কাছে পরিবেশ বান্ধব কৃষি প্রযুক্তির সেবা পৌঁছে দিতে গ্রামে গ্রামে ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতাল কৃষাণ-কৃষাণীদের পরামর্শ দিয়ে ফিরছেন এক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বকুল হোসেন।
শুধু কী মানুষেরই রোগ বালাই হয়, এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর কৃষিবিদদের। যার প্রাণ আছে, তারই রোগ আছে। মাটি এবং গাছেরও প্রাণ আছে। তাই শাকসবজি, ফলমূলসহ গাছেরও রোগ আছে। এসব রোগের ওষুধও আছে। গাছের রোগবালাই দূর করতে কৃষিবিদদের গবেষণায় তৈরি হয়েছে নানা রকম ওষুধ।
সরেজমিনে গাংনী উপজেলার অলিনগর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বকুল হোসেন গ্রামের কৃষাণ-কৃষাণীদের সবজির রোগ প্রতিরোধে করণীয় ও রোগাক্রান্ত সবজির রোগ প্রতিরোধে পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রতিদিনই কৃষাণীরা বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষের পরামর্শ ও বালাইনাশক নিচ্ছেন। মাঠের চাষিরা বিভিন্ন ফসল নিয়ে পরামর্শ নিতে আসছেন ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালে।
চিকিৎসা সহায়তা নিতে আসা কৃষাণ-কৃষাণীরা বলেন, ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতালের মাধ্যমে ফল ও সবজির পোকামাকড় দমনের জন্য বিষটোপ তৈরি, অন্যান্য ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য জৈব বালাইনাশক তৈরির কৌশল শিখেছি। পোকা দমন পদ্ধতির মাধ্যমে রোগমুক্ত সবজি উৎপাদন করতে পারছি। অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করতে হচ্ছে না। তাছাড়া রাসায়নিক সারের ব্যবহার বন্ধ করে জৈব সারে সবজি উৎপাদন করার পরামর্শ নিচ্ছি।
পরামর্শ নিতে আসা অলিনগর গ্রামের কৃষাণী মাজেদা খাতুন বলেন, আমাদের কৃষি হাসপাতালের ডাক্তার প্রথমে বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষে গ্রামের কৃষাণীদের উদ্যোগী করেন। সবজির রোগবালাই প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিতে গত বছরের জুন মাসের পর থেকে প্রতি সপ্তাহে গ্রামে আসেন তারা।
পরামর্শ নিতে আসা একই গ্রামের শেফালী খাতুন বলেন, রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে জৈব সার তৈরি ও তার ব্যবহারবিধি শিখেছি। রোগবালাই হলে কোন সময় কোন ওষুধ দিতে হবে, সেই পরামর্শ নিয়েছি। আগে কৃষি সম্পর্কে পরামর্শ নিতে হলে শহরে যেতে হতো। এখন বাড়িতেই চলে আসেন কৃষি কর্মকর্তারা। এখন আমাদের অলিনগর গ্রামে ৮০টি বাড়ির উঠানে ক্ষতিকর পোকা দমনের জন্য জৈব বালাইনাশক তৈরি ও পোকা দমন পদ্ধতির মাধ্যমে রোগমুক্ত সবজি উৎপাদন হচ্ছে। এমন হলে আমাদের জেলায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে।
ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতালের চিকিৎসক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা বকুল হোসেন বলেন, জৈব কৃষির বিস্তার অতিদ্রুত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে এসব পরামর্শ প্রদান করছি। এখানে হাতে-কলমে ব্যবহারবিধি শেখানো হয়। ফলে গ্রামাঞ্চলের মানুষ কম খরচে বিষমুক্ত নতুন নতুন জাতের ফল উৎপাদন করছেন। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে কালেকশন পয়েন্টের মাধ্যমে বাজারজাত করে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ বলেন, মেহেরপুরের মাটিতে সব ধরণের ফসল উৎপাদন হয়। তাই কৃষি নিয়ে কৃষকদের সব সময়ই পরামর্শ দেওয়া হয়। কৃষিক্ষেত্রকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের মাধ্যমে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে জেলার সব ব্লকেই ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতালের মাধ্যমে পরামর্শ দেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, নতুন নতুন ফলের জাত আলু বোখারা, জাবাটিকাবা, শরিফা, এলাচি চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে মেহেরপুর জেলায়।
জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, দেশে প্রথম ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতাল চালু হয়েছে মেহেরপুরে এবং এটা ব্যতিক্রম। দেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ পুষ্টি নিয়ে ভাবছে। এ ভাবনাতেই মেহেরপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ কৃষি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। কৃষি হাসপাতালের মাধ্যমে জেলার কৃষকদের কৃষি উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা দূর হওয়ার পাশাপাশি কৃষি উৎপাদনে বিরাট অবদান রাখবে। ইতিমধ্যে জেলার গাংনী উপজেলায় পরীক্ষামূলকভাবে এলাচি ফল চাষ শুরু হয়েছে। আগামী দুই-চার বছরের মধ্যে মেহেরপুরের মাটিতে এলাচি উৎপাদিত হবে। গাংনীর তেরাইল ব্লকের বসতভিটায় ৫৫ হেক্টর অব্যবহৃত জায়গায় পুষ্টিকর সবজি বাগান করা হয়েছে। হরেক রকমের ফল ও শাকসবজি উৎপাদিত হচ্ছে। চলতি মৌসুমে বাড়ির আঙিনার ৮০০ টন লাউ, ১০০ টন করলা, ২০০ টন শসা, ৫০০ টন টমেটো, ২৪৫ টন মুলা, ১৮০ টন পালং, ৬০ টন বরবটি, ৬০ টন লালশাক, ৩৫০ টন পেঁপে, ৪০ টন গাজর উৎপাদিত হয়েছে।